Part 1 স্বামীজি→ নারী শিক্ষা : নীলাক্ষী অধিকারী
- Jana Ajana
- Aug 30, 2020
- 5 min read
স্বামী বিবেকানন্দের অজানা দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় নারী শিক্ষায়____-

"There is no chance of the welfare of the
world unless the condition of women is
improved. It is not possible for a bird to
fly on one wing "
_ Swami Vivekananda.
স্বামী বিবেকানন্দের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে একথা বোঝা যায় যে নারী জাতির কল্যাণ ব্যতীত একটি সমাজের উন্নতি সাধন কখনোই সম্ভব নয় তার মতে নারী জাতির উন্নতিরকরণে একমাত্র পথ হল 'শিক্ষা' । এই শিক্ষা হলো মানুষ গড়ার শিক্ষা নারী জাতিকে এক সুসম্পন্ন বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক রূপে প্রদর্শিত করবে । স্বামীজীর মতানুযায়ী নারী ও পুরুষ হল সমাজের দুটি চাকা , যদি একটি চাকাও নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সমাজের অগ্রগতিও রুদ্ধ হবে । তাই নারীজাতির পরিপূর্ণতা লাভের অন্যতম উপাদান হলো শিক্ষা ।
ভারতীয় সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রাচীনকালে নারীদের 'দেবী' রূপে দেখা হতো ও 'মাতা' সম্বোধন করা হত কিন্তু মধ্যযুগের (অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ) নারী জাতির অবস্থার অধঃপতন শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা চলতে থাকে । অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল । এইরূপ অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করার অন্যতম উপায় ছিল তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা ।
স্বামী বিবেকানন্দ নারী শিক্ষা প্রচারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেশের মেয়েরা নিজেরা শিক্ষিত না হলে কুসংস্কার দূর করা, সমাজ সংস্কার করা বা নারী কল্যাণ অসম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। এ কারণে শহরে ও গ্রামে নারী শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা তিনি বলেছিলেন ।
নারী শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :
স্বামীজি ভারতীয় নারীদের জগৎ মাতা রূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং এটি তার স্ত্রী শিক্ষা পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য তার মতে - স্ত্রী শিক্ষা নারীর বন্ধন মুক্তির কারণ হবে ,এই বন্ধন বলতে স্বামীজি মানসিক ও সামাজিক বিধি নিষেধ এর কথায় বলেছেন । নারীকে কেবল পুঁথিগত শিক্ষায় সমৃদ্ধ দেখতে তিনি চাননি , নারীদের মধ্যে যে আলোকিত অস্তিত্ব রয়েছে তাকে তিনি লোকচক্ষুর সামনে আনতে চেয়েছেন । নারী জাতির সমস্যা সমাধানের জন্য পুরুষদের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করলে চলবে না , এই কাজে তাদেরকেই(নারীদের) এগিয়ে আসতে হবে , কারণ মেয়েদের সমস্যা মেয়েরা নিজেরা যেমন বুঝতে পারবে অন্যদের পক্ষে সেই সকল সমস্যা বুঝতে পারা সম্ভবপর হবে না । উৎপীড়ন ও অবহেলার শৃঙ্খলা মুক্ত করে সুশিক্ষার মধ্য দিয়ে নারীর শক্তিময়ী রূপটি বিকশিত হতে পারবে ।

স্বামীজীর মতে নারী শিক্ষা :
স্বামী বিবেকানন্দ স্ত্রী শিক্ষার জন্য যে পরিকল্পনা করেছিলেন তার মূল ভিত্তি ছিল সনাতন ধর্ম নৈতিকতা আজীবন ব্রত পালনের মত ঐকান্তিক নিষ্ঠা তার কাছে আদর্শ হলো সীতা চরিত্র যিনি অগ্নির মতো বিত্র এবং ভাস্বর । তাঁর ভাষায় " শিক্ষা বলিতে কত গুলি শব্দ শেখা নহে ; আমাদের বৃত্তি গুলি শক্তি সমূহের বিকাশকেই শিক্ষা বলা যাইতে পারে। শিক্ষা বলিতে ব্যক্তিকে এমন ভাবে গঠিত করা , যাহাতে তাহার ইচ্ছা সদ্বিষয় ধাবিত হয় ও সফল হয় । এইভাবে শিক্ষিতা হইলেই ভারতের কল্যাণ সাধনে সমর্থ, নির্ভীক, হৃদয়, মহিয়সী নারীর অভ্যুদয় হইবে "। স্বামীজি নির্দেশিত স্ত্রী শিক্ষা ব্যবস্থা পুরুষদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেশি কিছুটা পৃথক কারণ -
নারী কূলের সমস্যা অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির ।
গৃহস্থলির উৎকর্ষতা বহু পরিমাণে স্ত্রী লোকের উপর নির্ভরশীল ।
ভারতের মতো দেশের সমস্যা হল - নারী কেন্দ্রিক অবরোধ প্রথা , পরাধীনতা, পরনির্ভরশীলতা । বিদ্যাসাগর মহাশয় যেমন নারী সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে , সেখানে স্বামীজি তাঁর সমাধান সূত্র পেয়েছিলেন সাবলম্ব ও পারস্পরিক সহায়তার মধ্য দিয়ে ।

১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে স্বামীজির ইংল্যান্ড পরিভ্রমণ এর সময় তাঁর সামনে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল নামক এক আইরিশ মহিলার পরিচয় হয় এবং সেই মহিলা স্বামীজির ভাবাদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করে ভারতবর্ষে আসেন । সেই মহিলা পরবর্তী কালে স্বনামধন্যা ভগ্নী নিবেদিতা রূপে ভারতবর্ষের নারী জাতির উন্নতি কল্পে এক অসামান্য ভূমিকা পালন করেন । নারী শিক্ষার উন্নতি সাধনের জন্য ভগ্নী নিবেদিতা উত্তর কলকাতার বাগবাজারে একটি বিদ্যালয় নির্মাণ করে যা বর্তমানে 'রামকৃষ্ণ-সারদা মিশন ভগ্নী নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয় (<-click ) নামে অভিহিত ।

নারী শিক্ষায় পার্থক্য বিবেকানন্দ বলেছেন - ইচ্ছা শক্তির বিকাশ হল শিক্ষার লক্ষ্য, বাক( বলা ) , চিন্তা , কর্মের শুদ্ধতাই হল প্রধান শিক্ষা । শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা চর্চা করে প্রচুর তত্ত্ব ও তথ্য কণ্ঠস্থ করাই শিক্ষা নয় , এই শিক্ষা সংকীর্ণতার দ্বারা চরিত্র গঠন ও পূর্ণ মানুষ হওয়া যায় না । স্বামীজি চেয়ে ছিলেন এমন শিক্ষা যা মানুষকে দেবে লৌহ পেশি ইস্পাতের মত দৃঢ়, প্রবল ,অনমনীয় মানসিক শক্তি যার ফলে সে নিখিল বিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটন করে সকল বাধা জয় করে , জীবনের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে । নারী শিক্ষার পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত স্বামীজীর যে সমস্ত বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব

আরোপ করেছিলেন সেগুলি হল নিম্নরূপ -
১ । নৈতিক মূল্যবোধ : শিক্ষা বা ইংরেজি শব্দ Education যদি বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যায় তা ল্যাটিন শব্দ " Educatum" থেকে উৎপত্তি, যার 'E' অর্থাৎ 'Progress from inward to outward' বা অন্তর্মুখী পথ থেকে বহু মুখী পথে উত্তরণ, 'Duco' অর্থাৎ 'Developing' বা উন্নতিকরণ , অর্থাৎ শিক্ষা হল এক পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের জীবনের উন্নতি সাধন ঘটানো, শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো মানুষের চরিত্র গঠন। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয় । নৈতিকতা, মূল্যবোধ , সততা এগুলি ব্যতীত একটি আদর্শ চরিত্র গঠন সম্ভবপর নয় । তাই তিনি শিক্ষার মাধ্যমে এই গুলির পরিপূর্ণ বিকাশ লাভের মধ্য দিয়ে নারীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধনের কথা বলেছেন ।
২। সাহিত্য পাঠ ও সংস্কৃত : নারী শিক্ষার অন্যতম এক পাঠ্যক্রম রূপে স্বামীজি সাহিত্য পাঠ ও সংস্কৃত শিক্ষার কথা বলেছেন । সাহিত্য পাঠের অন্যতম উদ্দেশ্য হল নিজের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ সাহিত্য-জীবনের অঙ্গ এবং সাহিত্য থেকে নারী জাতি জ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে নিজেদের কে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পারবে। যেহেতু সংস্কৃত ছিল সেই সময়কার পাঠদানের অন্যতম মাধ্যম । তাই তিনি সংস্কৃতি ব্যকরণের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন ।
৩। কারুশিল্প ও রন্ধন বিদ্যা : স্বামীজি নারীশিক্ষার পাঠ্যক্রমে কারুশিল্প ও রন্ধন বিদ্যার কথা বলেছেন নারীদের অন্যতম প্রধান কাজ হল রন্ধন বিদ্যায় পটিয়সী হওয়া । প্রাচীনকাল থেকেই দেশে দেখা যায় নারীদের অন্যতম এক স্থান হল রন্ধনশালা রান্নাঘর এক্ষেত্রে নারী শিক্ষায় স্বামীজির এক উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ প্রস্ফুটিত হয় অর্থাৎ তিনি মনে করতেন শিক্ষা শুধুমাত্র পুঁথিগত জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই সমস্ত রকম জ্ঞান এর সংমিশ্রণে হল শিক্ষা ।

৪। গার্হস্থ্য বিজ্ঞান চর্চার সাথে উপাসনা ও ধ্যান : যেহেতু নারীরা গৃহকর্মে নিপুন হয় তাই তাদের শিক্ষার অন্যতম এক বিষয় হল গার্হস্থ্য বিজ্ঞান । এর সাথে সাথে নারী শিক্ষার পাঠ্যক্রমে ধর্মশাস্ত্র রাখা হয়েছে। এছাড়াও তিনি ধ্যান চর্চা কেউ নারী শিক্ষার পাঠক্রমে রাখার কথা বলেছেন অর্থাৎ এই সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান লাভের মাধ্যমে নারীদের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন সম্ভব ।
৫। মাতৃভাষায় শিক্ষা : স্বামীজি নারীশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার উপর গুরুত্বারোপ করেন অর্থাৎ মাতৃভাষাকে তিনি শিক্ষা লাভের অন্যতম মাধ্যম রুপে বিচার করেন ,তবে তিনি নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইউরোপীয় জ্ঞান- বিজ্ঞান ,শিল্প, ইতিহাস-ভূগোল ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন ।
"নারী শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিভঙ্গি প্রথম পর্ব " আজ এই পর্যন্তই প্রকাশিত হল । এর পরের পর্বে আমরা স্বামীজীর দৃষ্টিতে নারী শিক্ষার স্বরূপ কিরূপ হওয়া উচিত সেই সম্পর্কে আরো নানান তথ্য জানব । এছাড়াও এর পরের পর্বে আর্থার দ্বিতীয় পর্বে বর্তমান সমাজে স্বামীজির নারী শিক্ষার তাৎপর্য এর কথা তুলে ধরবো ।

ধন্যবাদ:
নীলাক্ষী অধিকারী

nilakshiadhikari1995.na@gmail.com
ঠিকানা : janaajana46@gmail.com
নারী শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দ , নারী-পুরুষের সাক্ষরতার হারে 35% বৈষম্য https://janaajanahistories.wixsite.com/janaajanahistories/post/স-ব-ম-ব-ব-ক-নন-দ-র-দ-ষ-ট-ভঙ-গ-ন-র-শ-ক-ষ-য