পুরুলিয়া শহরের গোপন দেবতা
- Jana Ajana
- Sep 12, 2021
- 4 min read
পুরুলিয়া শহরের আনাচে কানাচে অনেক দুর্গা মন্দির, কালিমন্দির, শিব মন্দির, হরি মন্দির, মনসা মন্দির ইত্যাদি দেবালয় বা উপাসনা স্থল রয়েছে । এই সব মন্দির গুলোর মধ্যে দুটি বিখ্যাত মন্দির হল খেলাইচণ্ডী মেলা ও নাক কাটা কালী মন্দির ।এই দুটি মন্দিরই পুরুলিয়া শহরের দুই প্রান্তে অবস্থিত । শহরের দুই প্রান্তে অবস্থিত হলেও এই দুই মন্দিরে বৈশিষ্ট্য হল এদের আরাধ্য প্রস্তর মুর্তির মধ্যে । প্রথমে আলোচনা করছি খেলাইচণ্ডী মেলা নিয়ে আর তার পর আলোচনা করব নাককাটা কালী মন্দির নিয়ে । click here
খেলাইচণ্ডী মেলা : খেলাইচণ্ডী মেলা পুরুলিয়া শহরের 16 নং ওয়ার্ড-এ অবস্থিত । ধবঘাটা জলট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি সোজা চলে গেছে ,সেই রাস্তার বাঁ-পাশে একটি উঁচু জমিতে একটি বৃহৎ চাটানের ছাউনিতে খেলাইচণ্ডী থানটি অবস্থিত । খেলাইচণ্ডী নামটি শুনে মনে হবে এখানে দেবী চণ্ডীর পুজা হয় । কিন্তু খেলাইচণ্ডী মেলাতে যে মূর্তি পুজিত হচ্ছে সেটি কখনো মাতৃ মুর্তি বা দেবী মুর্তি নয় । এখানে দেখতে পাবেন একটি দিগম্বর দেব মূর্তি , যিনি দেবী চণ্ডী রূপে পুজিত হচ্ছেন ।
আসলে এই দিগম্বর দেব মুর্তিটি হল জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের । ঋষভনাথকে : ঋষভদেব, আদিনাথ ও আদিদেবও বলা হয়ে থাকে । ঋষভনাথকে অনেকটা ভগবান শিবের মতো দেখতে এবং শিবকেও আদিনাথ বা আদিদেব বলা হয়ে থাকে। খেলাইচণ্ডীতে যে মূর্তিটি রয়েছে ,সেটি লম্বায় প্রায় 2.7 ফুটের বেশি এবং চওড়ায় প্রায় 1.5 ফুটের মতো । মূর্তিটির মাথার উপর রয়েছে ত্রি-স্তরিয় ছত্র বা ছাতা । ঋষভনাথের মাথায় রয়েছে জটা মুকুট । শিবের যেমন মাথায় জটা রয়েছে ঠিক তেমনি আদিনাথ ( জৈনধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ) মাথাতেও জটা মুকুট রয়েছে , জাটা দেবের কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে । কান গুলো আকারে বেশ বড় ,

কান গুলো বড় করে দেখানো মাধ্যমে ব্যাক্তির অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের বিস্তারকে বোঝানো হয়েছে । ঋষভনাথ কায়োৎস্বর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান , মাথার পেছনে রয়েছে জ্যোতি বলয় । পায়ের নিচে খোদিত রয়েছে ঋষভনাথের লাঞ্ছণ চিহ্ন "বৃষ" অর্থাৎ ষাঁড় । আর এই লাঞ্ছণ চিহ্ন দেখেই আমরা প্রতিটি তীর্থঙ্করকে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে পারি । লাঞ্ছণ চিহ্নের উপর পদ্ম ফুলের আকৃতি রয়েছে , যার ওপরেই রয়েছেন ঋষভদেব । দেবের পায়ের দুপাশে রয়েছে একজন করে চামরধারি পরিচারক । চামর ধারি দুজনেই ধুতি পরে রয়েছেন । দেবের দুপাশে খোদিত রয়েছে 24 জন তীর্থঙ্কর ছোট ছোট মূর্তি । দেখা যাব দুই পাশে চারটি করে ব্যালকনীতে তিনটি করে সারিবদ্ধ ভাবে 24 জন তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদিত রয়েছে । দেবের জটা মুকুটের দু পাশে রয়েছেন একটি করে উড়ন্ত পরি জাতীয় মুর্তি যাদের হাতে রয়েছে তারের তৈরী বাদ্য যন্ত্র । পঞ্চরথ সিংহাসনে লাঞ্ছণ চিহ্ন ষাঁড়ের বাঁদিকে রয়েছে একজন পুরুষ এবং ডানদিকে রয়েছে একজন নারী মুর্তি , এরা দুজনেই আদিনাথের উপসনালয় মগ্ন ।

খেলাইচণ্ডী মেলাই এই মূর্তিটির আনুমানিক খ্রীষ্টিয় নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর সময়কার । সম্ভবতঃ ঋষভদেবর এই মূর্তি টিকে অন্য কোন স্থান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল । বর্তমানে মূর্তিটিকে কমলা রঙে রঙ করা হয়েছে । তবে আশ্চর্যের বিষয় হল একটি দিগম্বর জৈন দেবতা কিভাবে দেবী চণ্ডী রূপে পুজিত হচ্ছেন !
তবে একথা সত্যি পুরুলিয়াতে এক সময়ে জৈন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য তার উৎকৃষ্টতম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল , যার মধ্যে অধিকাংশ ভাস্কর্য চুরি হয়ে গেছে এবং স্থাপত্য গুলির প্রায় সবকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে । ভাস্কর্যের মধ্যে যেগুলি টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশই কোথাও চন্ডী , কালভৈরব মনোসা , শিব, ধর্মরাজ , কালী ইত্যাদি হিন্দু দেবদেবী রূপে পূজিত হয়ে আসছে ।
খেলাইচণ্ডী মেলার মতো আরেকটি উদাহরণ হল পুরুলিয়া শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত নাক কাটা কালী মন্দির ।
নাক কাটা কালী মন্দির : পুরুলিয়া শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দুলমী বাঁধের পেছনে রয়েছে পুরুলিয়া শহরের অন্যতম কালী মন্দির নাককাটা কালী মন্দির। এই মন্দির কে ঘিরে রয়েছে নানান রোমহর্ষক কাহিনী , যদিও সেই সব কাহিনী সম্পর্কে আলোচনা করব না । খেলাইচণ্ডী মেলার মতো এখানেও রয়েছে একটি দিগম্বর জৈন মূর্তি । মূর্তি টির অনেকাংশেই ক্ষয়প্রাপ্ত । মূর্তিটির হাঁটুর নিচের অংশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে এবং সেই অংশটি লুপ্ত । মূর্তিটি 23 তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের । এটি ছিল সম্ভবত দেউল এর প্রধান আরাধ্য দেব । পার্শ্বনাথে মূর্তিটি কায়োৎস্বর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান ( সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ) ত্রিরথ সিংহাসন এর ওপর ।

দেবের পেছনে মাথার উপর রয়েছে সাত ফণা বিশিষ্ট সাপ এবং তার উপর রয়েছে ত্রিস্তরীয় ছাত্র বা ছাতা (ছাতা যেটি বর্তমানে নেই) । মাথার চুল কোঁকড়ানো এবং তার উপর রয়েছে একটি উসিনিস( চুলের ঝুটি )। পার্শ্বনাথের মূর্তির মাথা পেছনে দেখা যাচ্ছে শিরোসিচক্র ( দেবজ্যোতি ) । পার্শ্বনাথের মূর্তি চিহ্নিতকরণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল যে এই দেবতার সঙ্গে সাপ থাকবেই অর্থাৎ এই তীর্থঙ্করের লাঞ্ছণ চিহ্ন হল সাপ বা সর্প । দেবের দুই পাশে রয়েছেন নবগ্রহের মূর্তি মে গুলির চিহ্নিতকরণ করা অসম্ভব । মূর্তিটির সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী ।
নাককাটা কালী মন্দিরটি বিশাল বড় গাছের তলায় পাথর ও ইঁট দ্বারা তৈরী । গাছটি এই মন্দিরের উপরে অবস্থিত। মন্দিরের বাইরে চোখে পড়বে পাথরের ভগ্নাংশ যা দেখে অনুমান করা যায় কোন এক সময় এই এলাকায় একটি জৈন দেউল ছিল ।
মন্দিরের একপাশে রয়েছে আমলক শিলার দুই খণ্ড , যেগুলি এখানে মা কালীর পদ চিহ্ন রূপে পুজিত হচ্ছে ।
আমলক হল পাথরের তৈরী একটি বড় চক্র যেটি প্রতিটি দেউলের মাথার উপর থাকে (পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের মাথায় যে চক্রাকার আকৃতি দেখা যায় সেটিকে আমলক বলে । পুরুলিয়াতে অনেক দেউল আছে যাদের মাথায় এই ধরনের আমলক দেখা যায় ।)

পার্শ্বনাথের মূর্তি দেখতে অনেকটা ভগবান বিষ্ণুর মতো হয় । বিষ্ণুর মাথার পেছনে যেমন থাকে পাঁচ মুখ বিশিষ্ট শেষনাগ । তেমনি ভগবান পার্শ্বনাথের মাথার পেছনে থাকে সাত মুখ বিশিষ্ট সাপের আকৃতি , যেটিকে দেখে অনেকেই এনাকে বিষ্ণুমূর্তি বলে মনে করে থাকেন ।

এছাড়াও এখানে মন্দিরের পিছনে রয়েছে প্রাচীন দেউলের একটি ধ্বংসাবশেষ (শিলাখণ্ড) যেটিকে বর্তমানে শিব রূপে পুজা করা হয়ে থাকে । এই নাককাটা কালী মন্দিরের মূর্তিটির অবস্থা খুব শোচনীয় । যদি এটিকে সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে, বিগত 10 বছরের মধ্যে মূর্তিটি সম্পূর্ণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে এবং হারিয়ে যাবে পুরুলিয়ার প্রাচীন ইতিহাসের একটি অংশ ।
ধন্যবাদ
ত্রিদিবেশ চ্যাটার্জ্জী
Comments