কুশান মুদ্রায় ভারতীয় ও ইরাণী দেব-দবী
- Jana Ajana
- Aug 26, 2020
- 4 min read
Updated: Aug 27, 2020
চীন দেশের অধিবাসীদের কাছে ইউ-চি নামে পরিচিত এক ভ্রাম্যমান উপজাতি চীন দেশের অভ্যন্তরে সীমানার নিকটবর্তী বাসভূমি পরিত্যাগ করে ব্যাকট্রিয়াতে অক্ষু নদীর অববাহিকায় এসে বসতি স্থাপন করে । সেখানে প্রায় এক শতাব্দী বসবাস করার পর ইউ-চি জাতির একটি শাখা কিউ-সুয়াং (কুশান) বংশের জনৈক রাজপুত্র পার্থিয়া বা আফগানিস্থানের ভারত পার্থ রাজ্যে আক্রমণ চালিয়ে মধ্য আফগানিস্থান, গান্ধার এবং নিম্ন সোয়াত উপত্যাকা অধিকার করেন । তার বংশধরগণ উত্তর ভারতের রাজ্য বিস্তার করে, যে উত্তর ভারত এতদিন পর্যন্ত বিদেশি অভিযান এড়িয়ে যেতে পেরেছিল। কুশান গন পূর্ব বারানসি পর্যন্ত এবং পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে এইভাবে তারা যে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তা এক শতাব্দীর চেয়েও দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল ।
ভারতের প্রথম কুশান নৃপতি কুজুল কদপ্সিসের প্রচলন করা তাম্রমুদ্রাই ভারতীয় কুশানদের প্রস্তুত যে সব মুদ্রা পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন । এই সমস্ত মুদ্রাগুলি মধ্যে সর্ব পুরাতন মুদ্রাটির সামনের দিকে সর্বশেষ ব্যাকট্রিয় নরপতি হেরমেউস্ এবং বিপরীত দিকে হেরাক্লেস এর আবক্ষ প্রতিমূর্তি অঙ্কিত রয়েছে ।
কুজুলের পরবর্তী রাজা ভীম কদপ্সিসের মুদ্রা তাঁর পিতার মুদ্রার চেয়ে এত বেশী পৃথক যে অন্য কোনো প্রমাণ না থাকলে শুধুমাত্র মুদ্রার প্রমাণের ওপর নির্ভর করলে তাঁর সরাসরি সিংহাসন গ্রহণ অসম্ভব বলে মনে হত । ভীম কদপ্সিস যে তিনটি মূল্যের মুদ্রা চালু করেন সেগুলি হল - দুই-দিনার, একদিনার এবং সিকি দিনার । সিকি দিনার মুদ্রাটি খুব দুর্লভ । মুদ্রার সামনের দিকে ভীমকে একজন হৃষ্টপুষ্ট বয়স্ক পুরুষ রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। বিভিন্ন মুদ্রায় তাকে কৌচে, জানালার ধারে এবং পায়ের উপর পা তুলে বসা অবস্থায় দেখা গেছে । এছাড়াও তাঁকে হস্তী এবং বৃষারোহী রূপে এবং যজ্ঞবেদীতে উৎসর্গ করেছেন এই চিত্রে দেখা গেছে । যজ্ঞবেদীতে উৎসর্গ করার দৃশ্যটি পরবর্তী কোন রাজাদের মুদ্রা মূল বিষয়বস্তু হিসেবে বারবার উৎকীর্ণ করা হয়েছে । কয়েকটি মুদ্রায় ভীমকে মেঘের মধ্যে উড্ডীয়মান অবস্থায় অথবা মেঘ থেকে নেমে আসছেন দেখানো হয়েছে । আর তার কাঁধ থেকে অগ্নিশিখা বিচ্ছুরিত হচ্ছে দেখা যাচ্ছে । এর থেকে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় যে তিনি প্রজাদের কাছে স্বীয় দেবত্বের দাবী করেছিলেন । ভীমের প্রচলন করা মুদ্রার বিপরীত দিকে সুদীর্ঘ ত্রিশূলধারী শিবের চিত্র অঙ্কিত দেখা গেছে । অনেকক্ষেত্রেই শিবের বাহন ষাঁড়ের চিত্র উপস্থিত । এর থেকে বোঝা যায় যে তিনি ভারতীয় পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন এবং নিজেকে

শৈব বলে প্রচার করেছিলেন । কুষাণদের প্রচলিত মুদ্রার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নৃপতি ভীম কদপ্সিসই শেষ কুশান রাজা যিনি গ্রীক ও খরোষ্ঠী লিপিতে দ্বিভাষিক মুদ্রার প্রচলন করেন ।
ভীম কদপ্সিসের পরবর্তী শাসক কনিষ্ক(প্রথম কনিষ্ক) কনিষ্কের মুদ্রা তে দেখা গেছে বা হাতে একটা বর্ষা ধরে যোজ্ঞবেদীর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, পরিধানে লম্বা শালোয়ার ধরনের লম্বা জোম্বা(tunic) এবং মাথায় গোলাকার নিচু টুপি । কিন্তু মুদ্রার বিপরীত দিকে কোন একটিমাত্র বিশেষ দেবতার প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত থাকত না । মুদ্রার ওপর গ্রীক ও খরোষ্ঠী দুই ভাষাতেই লিপি উৎকীর্ণ করার প্রথা তুলে দিয়ে তিনি শুধুমাত্র গ্রীক ভাষায় ব্যবহার শুরু করলেন এবং তার প্রচলন করা মুদ্রার ওপর লেখা থাকত 'ব্যাসিলেয়াস ব্যাসিলিয়ন কনিষ্কৌ । এই সব মুদ্রার বিপরীত দিকে হেলিওস , সালেন এবং হেপহাইস্টোস এই তিন জন দেবতার ছবি আঁকা আছে যাদের নাম গ্রীক হলেও চিত্রাঙ্কন রীতি অনুযায়ী তাদের আদৌ গ্রীক বলা চলে না । তবে কিছুদিনের মধ্যেই কনিষ্কের মুদ্রায় মধ্য-ইরাণী / শক ভাষার প্রচলন লক্ষ্য করা যায় ফলে কনিষ্কের মুদ্রায় 'শাওনানো শাও কনিষ্ক কোশানো ' কথা গুলি লেখা থাকত । এই সব মুদ্রায় অনেক

ইরানি দেবদেবীর মূর্তি চিত্রিত আছে , এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মিহির বা মিথ্র(সূর্য), মাও(চন্দ্র), ওয়াদো(বায়ু), ওরলাগ্নো (জাতীয় যুদ্ধের দেবতা , লুহ্রাস্প(জীবজন্তুর দেবতা ) , অ্যাথশো(অগ্নি), #ফ্যারো(ঐশ্বর্যের দেবতা) , মানাওবাগো (হৃদয় বা মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা) , মাজদা( জোরাসট্রিয়ান ধর্মের সর্বোত্তম দেবতা ) , নানা/নানা শাও / নানিয়া ( প্রকৃতির দেবী ) এবং
আর্দোক্সো ( হিন্দুদের লক্ষ্মীদেবীর অনুরূপ দেবী ) পূর্ববর্তী মৃতের মুদ্রায় যে শিবের চিত্র থাকতো সেই একই ছবি দেখা গেছে ওয়েশো(ভবেশ বা হবেশ) নামে এবং এছাড়াও বদ্দো বা শকমানো বদ্দো ( শাক্যমুনি বুদ্ধ) লেখা বুদ্ধের প্রতিচ্ছবি থাকত ।
কনিষ্কের পর কুষাণ সম্রাট হন হুবিষ্ক । কনিষ্কের মতো তাঁর মুদ্রাতে ইরানি দেবদেবীর প্রতিমূর্তি দেখা গেছে । এছাড়াও হুবিষ্ক আহুরা-মাজদা ( জোরাস্টীয় ধর্মানুযায়ী সর্বপ্রথম দেবতা )আশাইক্সোহো(সত্যের দেবতা) ,ওয়াক্সাহো(অক্সাস বা অক্ষু নদীর দেবতা ) , রিশ্নো ( নীতিবোধের দেবতা ) এবং শাওঁরেওরা (রাজকীয় শক্তি এবং ধাতুর দেবতা ) প্রভৃতি নতুন নতুন দেবতার প্রতিমূর্তি পাওয়া গেছে তাঁর মুদ্রায় । ভারতীয় দেবদেবীর মধ্যে হুবিস্ক শিবকে (ওয়েশো) স্বীয় মুদ্রা অঙ্কিত করিয়েছিলেন এবং শিবের চিত্রই সাধারণত বেশিরভাগ মুদ্রায় দেখা যায় কয়েকটি মুদ্রায় পত্নী উমা (ওম্মা) সহ শিবকে পাওয়া যায় । শিব এবং মা ছাড়া তাদের পুত্র কার্তিককেও হুস্কের স্বর্ণমুদ্রায় দেখা গেছে ।
হুবিষ্কের পর রাজা হন বাসুদেব । কনিষ্কের মত বাসুদেবের স্বর্ণমুদ্রার সামনের দিকে তিনি তার নিজের চিত্র অঙ্কন করেছেন তাতে দেখা যায় রাজা যজ্ঞবেদীতে উৎসর্গ রত । চিত্রে রাজাকে পাশ থেকে দেখানো হয়েছে । কনিষ্কের মুদ্রায় তাকে বর্ষা হাতে দেখানো হলেও বাসুদেবের মুদ্রায় বাসুদেবকে ত্রিশূল হাতে আঁকা হয়েছে । বাসুদেব বাঁহাতে ত্রিশূল ধরে আছেন । মুদ্রার বিপরীত পাশে রয়েছে নানা(ইরানি দেবী) এবং ওয়েশো (শিব) নামক দুজন দেবদেবীর ছবি ।জন দেবদেবীর

ছবি । এছাড়াও অনেক মুদ্রার বিপরীত দিকে উঁচু হেলান দেওয়ার ব্যবস্থা যুক্ত সিংহাসনে বসা আর্দোক্সো দেবী (সম্ভবত ভারতীয় ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর অনুরূপ দেবী ) দেবীর বাঁহাতে ধরা প্রাচুর্যের প্রতীক শঙ্কু আকৃতির পাত্রে শস্যাদি এবং ডান হাতে একটি রাজমুকুট । এই মুদ্রাগুলি সোজা দিকে ব্রাহ্মী লিপিতে দু একটা যে কথা আছে তার সঠিক অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়নি ।
যাইহোক রাজা বাসুদেব এবং তৃতীয় কনিষ্কের পর সম্ভবত কুষাণ বংশ লোপ পায় । অর্দশিরের রাজত্বকালে (২১২-২৪ খ্রীস্টাব্দে ) কোন সময়ে সাসানিডেরা(পারস্যের রাজবংশ) সিন্ধু নদের পশ্চিমস্ত কুশান রাজ্য দখল করে নেয় । উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তানে ছোট ছোট কুষাণ রাজ এবং সাসানিড প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অধীনস্থ কুষাণ রাজ্যসমূহ ধীরে ধীরে কিদার নামক অন্য এক রাজবংশের অধীনে চলে যায় । নতুন এই রাজবংশের রাজা কিদার-এর নাম থেকে বংশের নাম হয় কিদার বংশ । এই বংশের উৎপত্তি হয় ইউ-চী বংশ থেকে যা কুষাণদের সৃষ্টি অথবা এই কিদর বংশ হুণ জাতি থেকে হয়েছে -- যে হুণদের কথা আমরা অনেক পরে শুনতে পাই ।
যাইহোক কুষাণদের প্রচলিত মুদ্রা তে আমরা আমাদের হিন্দু দেব-দেবীর যেমন মূর্তি দেখতে পায় ঠিক তেমনি ভাবেই ভগবান বুদ্ধ এবং ইরানি দেব-দেবীদের মূর্তি প্রচুর পরিমাণে দেখতে পায়। হিন্দু দেবদেবীর মধ্যে লক্ষ্মী দেবীর প্রথম মূর্তি আমরা কুশান মুদ্রাতেই দেখতে পায় ।

ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রথম স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন এবং তাদের পরবর্তীকালে গুপ্ত সম্রাট কুষাণদের স্বর্ণমুদ্রা কে তাদের স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করেছিলেন । কুষাণ বংশের শেষ দিকের রাজাদের মুদ্রার

বিপরীত দিকে ব্রাহ্মী লিপিতে একটি করে নাম পাওয়া গেছে যেমন - শ্রীশিলাদিত্য,
শ্রীকৃতবীর্য, শ্রীসালংবীর, শতমাল , সর্বস ইত্যাদি । নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই নাম তৎকালীন শাসকদের নাম যা হিন্দু ধর্মের দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিল ।
ধন্যবাদ Indian museum
Tridibesh chatterjee
Comentarios