top of page
Search

জঙ্গলে ঘেরা গড়পঞ্চকোট : অক্ষয় খাওয়াস

  • Writer: Jana Ajana
    Jana Ajana
  • Aug 23, 2020
  • 4 min read

ঘন জঙ্গল। বর্ষার জলে ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশের সবুজ, গাছের পাতায় বৃষ্টির জলের অনবরত পতন— মন চাইছিল এমন একটা অভিজ্ঞতা হোক। এ দিকে হাতে সময় কম।ইচ্ছে পূরণ হল। তাও আবার ঘরের কাছেই। জায়গাটা পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট। 


বৃষ্টিকে সঙ্গী করে গড়পঞ্চকোট পৌঁছনোর পর সে বিরতি নিল। সূর্যদেবও মেঘ সরিয়ে উঁকি দিলেন। চারিদিকে মায়াবী আলো। বৃষ্টির সঙ্গে রেস খেলতে খেলতে গন্তব্যে পৌঁছে বুঝলাম বেশ তেষ্টা পেয়েছে। জলের নয়, চায়ের! গড়পঞ্চকোটে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ে সম্প্রতি সংস্কার করা পঞ্চরত্ন মন্দির। তার সামনেই কয়েকটি ছোট ছোট চায়ের দোকান। সেখানে চা-বিস্কুটের সঙ্গে ছৌ মুখোশও বিক্রি হচ্ছে। চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ চলে গেল পাঞ্চেত পাহাড়ের দিকে। ঘন জঙ্গলের মোড়কে এই পাহাড়ের হাতছানি এড়ানো মুশকিল। কিন্তু বাধ সাধল চায়ের দোকানের বাচ্চা ছেলেটি, ‘‘ও দিকে এখন যাবেন না। জঙ্গলে প্রচুর সাপ, বিষাক্ত পোকামাকড়। অজগরও বার হয়।

শীতকালে আসবেন, আমিই নিয়ে যাব আপনাকে। পাহাড়ের মাথার উপর থেকে দেখবেন গোটা অঞ্চল। পাঞ্চেত বাঁধ। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। উপর থেকে ভিউটা খুব সুন্দর।’’ বাধ্য মেয়ের মতো কথা শুনতে ছেলেটি পুরস্কারস্বরূপ ঘুরিয়ে দেখাল গড়পঞ্চকোটের গেট, জোড় বাংলা, ওয়াচ টাওয়ার, রানি মহল— পঞ্চকোট রাজত্বের ভগ্নাবশেষ। যা এক সময় রাজা, প্রজা, সৈন্য নিয়ে গমগম করত।


গড় পঞ্চকোট ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে অবস্থিত একটি প্রত্নস্থল। এই স্থানটি ঐ অঞ্চল শাসনকারী শিখর রাজবংশের রাজধানী ছিল।


গড় পঞ্চকোট প্রায় পাঁচ মাইল বিস্তৃত একটি দুর্গ ছিল। এই গড়ের চারিপাশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বারো বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং এটি পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল। মূল দুর্গ পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল।


গড় পঞ্চকোটের অধিকাংশ স্থাপত্য বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা অবলুপ্তির পথে। এই স্থানে বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে, যেগুলি উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।


তোরণ:- ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে জে ডি বেগলার গড় পঞ্চকোট ভ্রমণ করে আঁখ দুয়ার, বাজার মহল দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার এবং দুয়ার বাঁধ নামক চারটি তোরণের বর্ণনা করেন। তিনি দুয়ার বাঁধ ও খড়িবাড়ি দুয়ারের গায়ে উৎকীর্ণ লিপিতে মল্লরাজ বীর হাম্বিরের নামের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন, যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে পঞ্চকোট রাজ্য মল্লভূমের অধীনস্থ হয়েছিল।


পঞ্চরত্ন মন্দির:- গড় পঞ্চকোটের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মন্দির হল একটি পঞ্চরত্ন টেরাকোটা নির্মিত দক্ষিণ ও পূর্বদুয়ারী রাস মন্দির। মন্দিরের গায়ে ফুল ও আলপনার নকশা ছাড়াও খোল, করতাল বাদনরত ও নৃত্যরত মানব-মানবীর মূর্তি পরিলক্ষিত হয়। ষাট ফুট উচ্চ কেন্দ্রীয় চূড়া বিশিষ্ট ভগ্নপ্রায় এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। উত্তরপশ্চিম দিকে অপর একটি পঞ্চরত্ন টেরাকোটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, বর্তমানে যার চারটি চূড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ও মধ্যের ৪০ ফুট উচ্চ চূড়াটি অবশিষ্ট রয়েছে।


গড়ের বাম দিকে প্রস্তর নির্মিত কল্যাণীশ্বরী দেবী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমান। এছাড়াও দুইটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত জোড়বাংলা মন্দির এই স্থানে অবস্থিত। এছাড়া পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ও কর্মচারীদের বাসস্থান অবস্থিত।


রাজা দামোদর শেখর ছিলেন পঞ্চকোটের প্রথম রাজা। সময়টা ৯০ খ্রিস্টাব্দ। পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী সর্দারের সাহায্যে এখানে তিনি রাজত্ব গড়ে তোলে


ন। আর সেই থেকেই নাম গড়পঞ্চকোট। ‘গড়’ মানে দুর্গ, ‘পঞ্চ’ মানে পাঁচ এবং ‘কোট’ মানে গোষ্ঠী। শোনা যায়, এই রাজার উত্তরসূরিরাই পঞ্চকোটে ছোট বড় মিলে প্রায় চল্লিশটি মন্দির তৈরি করেছিলেন। কোনওটা পোড়ামাটির, আবার কোনওটা পাথরের। যার মধ্যে এখন দু’-একটির ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। অবশ্য কিছু ঐতিহাসিকের বক্তব্য রাজারা নন, ধনী বণিকদের তৈরি এই মন্দির

গুলি। সে সময় দামোদর অববাহিকা জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা। বাংলায় বর্গিদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এই রাজত্ব। জনশ্রুতি, শেষ রাজার ১৭ জন রানি সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছিলেন



প্রকৃতির রূপ দেখে চোখ জুড়োনোর জন্য আদর্শ জায়গা গড়পঞ্চকোট। এখানে জঙ্গলে ঘেরা বনদফতরের বাংলোগুলিতে থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা এই জায়গাটির আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। গড়পঞ্চকোট থেকে মোটামুটি দু'কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত পাঞ্চেৎ বাঁধ থেকে অপরূপ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। বাঁধের জলে নৌকাবিহার করা যায়। 43 কিলোমিটার দূরে দামোদর নদীর ওপর মাইথন বাঁধ। আর এই মাইথন এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে দর্শন করে নেওয়া যায় মা কল্যাণেশ্বরীকে। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই দেবীর মন্দির আগে ছিল পঞ্চকোটে।

বর্গি হামলার সময় দেবীকে নিয়ে চলে আসা হয় এখানে। 


১৮৭২ সাল নাগাদ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পঞ্চকোট রাজার (সিং দেও রাজাদের) এস্টেট ম্যানেজার হিসেবে কিছুকাল এখানে চাকরি করেছিলেন। সেইসময়েই তিনি 'পঞ্চকোট গিরি', 'পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী' এবং 'পঞ্চকোট গিরি বিদায় সঙ্গীত' এই কবিতাগুলি রচনা করেন।



পঞ্চকোট গিরি বিদায় সঙ্গীত :-

হেরেছিনু, গিরিকবর ! নিশার স্বপনে,


অদ্ভুত দর্শন!

হাঁটু গাড়ি হাতী দুটি শুঁড়ে শুঁড়ে ধরে,
কনক-আসন এক, দীপ্ত রত্ন-করে


দ্বিতীয় তপন!
যেই রাজকুলখ্যাতি তুমি দিয়াছিলা,
সেই রাজকুললক্ষ্মী দাসে দেখা দিলা,

শোভি সে আসন
হে সখে! পাষাণ তুমি, তবু তব মনে


ভাবরূপ উৎস, জানি, উঠে সর্ব্বক্ষণে।
ভেবেছিনু, গিরিবর! রমার প্রসাদে,

তাঁর দয়াবলে ,



ভাঙা গড় গড়াইব , জলপূর্ণ করি
জলশূন্য পরিখায়; ধনুর্ব্বাণ ধরি দ্বারিগণ
আবার রক্ষিবে দ্বার অতি কুতূহলে


.                               ~ মাইকেল মধুসূদন দত্ত


•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

◾#সাইট #সিং :-


গড়পঞ্চকোটের কাছেপিঠে অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে জয়চণ্ডী পাহাড়, মুরাডি লেক, বড়ন্তি, বিহারিনাথ মন্দির ও পাহাড়। জঙ্গল-পাহাড়ে পাখি দেখেও কাটিয়ে দেওয়া যায় সময়।গড়পঞ্চকোটের ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আর একটি দ্রষ্টব্য স্থল কাশীপুর রাজবাড়ী আরেক ইতিহাস বহন করে। মুঘল আক্রমণের সময় পঞ্চকোট রাজারা তাঁদের গড় কাশিপুরে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। লাল ইঁট, পাথর ও কাঠের তৈরি এই রাজবাড়ীর স্থাপত্য ও শিল্প কলা অসাধারণ।

সবকিছুর পর কাশীপুরের বিখ্যাত দরবেশে মুখ মিষ্টি না হলে কিন্তু পুর ঘোরাটাই ফিকে হয়ে যাবে।


•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

◾#কীভাবে #যাবেন ?


হাওড়া থেকে ট্রেনে গিয়ে নামতে পারেন বরাকর, অথবা কুমারডুবি অথবা আদ্রা স্টেশনে। বরাকর থেকে গড় পঞ্চকোটের দূরত্ব ২২ কিমি। কুমারডুবি থেকে দূরত্ব ২৬ কিমি। আদ্রা থেকে দূরত্ব ২৩ কিমি। এই তিন স্টেশন থেকেই অটো বা গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যান গড় পঞ্চকোটে। কুমারডুবি সবচাইতে কাছে কিন্তু যোগাযোগ ভালো বরাকর বা আদ্রা কিংবা আসানসোল (৩৪ কিমি) থেকে। রেলপথ ছাড়াও সড়ক পথে NH-2 ধরে,আসানসোল থেকে দিশেরগড় হয়ে চিরকুন্ডা রোড ধরে পৌঁছে যেতে পারেন গড় পঞ্চকোটে বা পুরুলিয়া শহর থেকে আসানসোল-বরাকর রোড ধরে রঘুনাথপুর হয়ে পৌঁছে যেতে পারেন গড় পঞ্চকোটে।

 
 
 

Comments


tridibesh_edited.jpg

জানা-অজানা

ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভ্রমণ

Know your history

WEEKLY NEWSLETTER 

Thanks for submitting!

  • https://www.facebook.com/ChhauMaskandPuruliaTourGuide/?ref=pages_you_manage

© 2023 BY Tridebesh Chatterjee. Designed BY CAPTUREGRAPHICS.IN

bottom of page